সূরা ফীল বাংলা উচ্চারণ, শানে নুযূল, ফজিলত, শিক্ষা ও তাফসিল

সূরা ফীল বাংলা উচ্চারণ, শানে নুযূল, ফজিলত, শিক্ষা ও তাফসিল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে আজকের এই আর্টিকেলটিতে। সূরা ফীল সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ুন।
তাহলে চলুন, কথা না বাড়িয়ে এবং আপনারা মূল্যবান সময় নষ্ট না করে আজকের গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় সূরা ফীল বাংলা উচ্চারণ, শানে নুযূল, ফজিলত, শিক্ষা ও তাফসিল সম্পর্কে জেনে নিন।

সূরা ফীল বাংলা উচ্চারণ

সূরা ফীল (আল-ফীল) কুরআনের ১০৫তম সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং এতে ৫টি আয়াত রয়েছে।

সূরা ফীল (আরবি পাঠ)

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ ٱلْفِيلِ
أَلَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِى تَضْلِيلٍ
وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْرًا أَبَابِيلَ
تَرْمِيهِم بِحِجَارَةٍۢ مِّن سِجِّيلٍۢ
فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍۢ مَّأْكُولٍۢ

বাংলা উচ্চারণ:

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

  1. আলাম তারা কাইফা ফা'আলা রাব্বুকা বি-আসহা-বিল ফীল।
  2. আলাম ইয়াজ'আল কাইদাহুম ফী তাদলীল।
  3. ওয়া আরসালা 'আলাইহিম তাইরান আবাবীল।
  4. তারমীহিম বিহিজারাতিম মিন সিজ্জীল।
  5. ফাজা'আলাহুম কা'আসফিম মা'কুল।

এই সূরায় আল্লাহ সেই ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন যখন আব্রাহা কা'বা ঘর ধ্বংস করতে আসলে আল্লাহ তাকে ও তার বাহিনীকে ধ্বংস করে দেন।

সূরা ফীল এর শানে নুযুল

সূরা ফীলের শানে নুযুল (অবতরণের প্রেক্ষাপট)

সূরা ফীল মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং এটি মূলত এক ঐতিহাসিক ঘটনার স্মরণ করিয়ে দেয়, যা "হস্তী বাহিনীর ঘটনা" নামে পরিচিত।

হস্তী বাহিনীর ঘটনা:

ইয়েমেনের শাসক ছিল আবরাহা। সে মক্কার কাবা শরীফের প্রতি মানুষের আকর্ষণ কমাতে ইয়েমেনে এক বিশাল গির্জা নির্মাণ করেছিল, যাতে মানুষ হজ করতে কাবায় না গিয়ে সেখানে যায়। কিন্তু তার এই উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়, এবং সে ক্ষুব্ধ হয়ে কাবা ধ্বংসের সংকল্প করে।

আবরাহা বিশাল এক বাহিনী নিয়ে মক্কার দিকে অগ্রসর হয়। তার বাহিনীর সামনে ছিল এক বিশাল হাতি। এ কারণে এই ঘটনাকে "আসহাবে ফীল" (হাতিওয়ালাদের ঘটনা) বলা হয়।
কিন্তু যখন তারা কাবা ধ্বংস করতে আসে, তখন আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে এক বিশেষ শাস্তি পাঠান। আকাশ থেকে "আবাবীল" নামে একদল পাখি ছোট ছোট "পাথরের কংকর" ফেলে তাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়।

সূরা ফীলের বার্তা:
  • এই সূরা আল্লাহর অসীম শক্তি ও কুদরতের প্রমাণ।
  • কাবা ঘর আল্লাহর বিশেষ হেফাজতে রয়েছে।
  • দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনীও আল্লাহর ইচ্ছার সামনে কিছুই না।
  • যারা অহংকার ও জুলুম করে, তারা ধ্বংস হবেই।

সূরা ফীল মূলত মক্কার কুরাইশদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, কাবা ধ্বংস করতে আসা শক্তিশালী বাহিনীকে আল্লাহ কীভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন। এটি মানুষকে আল্লাহর ওপর নির্ভর করতে ও তার অসীম শক্তি সম্পর্কে সচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করে।

সূরা ফীল এর ফজিলত

সূরা ফীল কুরআনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা, যা আল্লাহর অসীম ক্ষমতা ও শত্রুদের ধ্বংস করার বর্ণনা তুলে ধরে। এই সূরার পাঠ ও আমলের মাধ্যমে অনেক কল্যাণ লাভ করা যায়।

১. আল্লাহর সাহায্য ও নিরাপত্তা লাভ
  • এই সূরা আমাদের শেখায় যে, আল্লাহ তাআলা দুর্বলদের রক্ষা করেন এবং দুশমনদের ধ্বংস করেন।
  • এটি নিয়মিত পড়লে আল্লাহর হেফাজত ও শত্রুদের হাত থেকে নিরাপত্তা লাভ করা যায়।
২. বিপদ ও শত্রু থেকে মুক্তি
  • কেউ যদি বিপদে পড়ে বা শত্রুর ভয় থাকে, তবে এই সূরা পাঠ করলে আল্লাহ তার রক্ষা ও শত্রুদের পরাজিত করবেন।
৩. দুর্ভাগ্য ও দুর্বলতা দূর হয়
  • অনেক ইসলামিক স্কলার বলেন, নিয়মিত এই সূরা পড়লে জীবনের বাধা-বিপত্তি দূর হয় এবং সফলতা আসে।
৪. দোয়া কবুলের মাধ্যম
  • এই সূরা পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর কুদরতের স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যা দোয়া কবুলের অন্যতম কারণ।
৫. জাদু ও বদনজর থেকে মুক্তি
  • কিছু ইসলামিক ব্যাখ্যায় বলা হয়, নিয়মিত এই সূরা পড়লে জাদু, বদনজর ও অশুভ শক্তির কুপ্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

সূরা ফীলের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর কুদরত, ন্যায়বিচার ও রক্ষাকবচের শিক্ষা পাই। এটি পাঠ করলে আত্মবিশ্বাস, নিরাপত্তা ও কল্যাণ লাভ করা সম্ভব। নিয়মিত আমল করলে দুনিয়া ও আখিরাতে উপকার পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।

সূরা ফীল এর শিক্ষা 

সূরা ফীল কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়; বরং এতে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রয়েছে, যা আমাদের জীবনে প্রয়োগ করা যেতে পারে। নিচে এর কয়েকটি মূল শিক্ষা দেওয়া হলো:

১. আল্লাহর শক্তি ও সার্বভৌম ক্ষমতা
  • পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনীও আল্লাহর সামনে কিছুই নয়।
  • তিনি যখন কাউকে ধ্বংস করতে চান, তখন ক্ষুদ্রতম মাধ্যম (যেমন: পাখি ও ছোট পাথর) দিয়েও করতে পারেন।
2. অন্যায়ের পরিণতি অনিবার্য
  • যারা অহংকার ও জুলুম করে, তারা শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়।
  • আবরাহা কাবা ধ্বংসের পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু আল্লাহ তাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেন।
3. আল্লাহ তাঁর ঘর ও বান্দাদের রক্ষা করেন
  • কুরাইশরা দুর্বল ছিল, কিন্তু আল্লাহ নিজেই কাবাকে রক্ষা করেন।
  • এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, যখন কোনো মুমিন আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তখন তিনি তাকে হেফাজত করেন।
4. বিশ্বাসীদের জন্য আশার বাণী
  • যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে আল্লাহর সাহায্য অবশ্যম্ভাবী।
  • বিপদে ধৈর্য ধরলে ও আল্লাহর ওপর ভরসা করলে তিনি আশ্চর্যজনকভাবে সাহায্য করেন।
5. শত্রুর ওপর নির্ভর না করা
  • কুরাইশরা আব্রাহার ক্ষমতার ভয়ে ছিল, কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি যে, সত্যিকারের শক্তি আল্লাহর।
  • পৃথিবীর কোনো ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, কেবল আল্লাহর ইচ্ছাই টিকে থাকে।

সূরা ফীল আমাদের শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহর শক্তি সবচেয়ে বড়, তিনি বিশ্বাসীদের রক্ষা করেন, আর অন্যায়কারীরা ধ্বংস হয়। এটি আমাদের আল্লাহর ওপর আস্থা ও ধৈর্য রাখার অনুপ্রেরণা দেয়।

সূরা ফীলের তাফসীর

সূরা ফীল (সুরা নম্বর ১০৫) একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সূরা, যা আল্লাহর অসীম শক্তি এবং দুশমনদের ধ্বংস করার বিবরণ প্রদান করে। এটি ঐতিহাসিক "আবরাহার হস্তীবাহিনীর ঘটনা" নিয়ে নাযিল হয়েছে।

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

অর্থ: পরম দয়ালু, অতি দয়াবান আল্লাহর নামে শুরু করছি।প্রতিটি সূরার শুরুতে এই বাক্য থাকে, যা আমাদের শেখায় যে, প্রত্যেক কাজ আল্লাহর নামে শুরু করা উচিত

১. أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ ٱلْفِيلِ

উচ্চারণ: আলাম তারা কাইফা ফা'আলা রাব্বুকা বি-আসহা-বিল ফীল। অর্থ: তুমি কি দেখনি, তোমার প্রতিপালক হাতিওয়ালাদের সাথে কী করেছেন?

আল্লাহ তাআলা এখানে নবী মুহাম্মাদ (সা.)-কে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, কাবা ধ্বংসের জন্য আসা আবরাহার বিশাল বাহিনীর কী পরিণতি হয়েছিল। "তুমি কি দেখনি?"—এটি এমন এক ভাষা, যা ঘটনার গুরুত্ব ও শিক্ষা গ্রহণের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।

২. أَلَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِى تَضْلِيلٍ

উচ্চারণ: আলাম ইয়াজ'আল কাইদাহুম ফী তাদলীল। অর্থ: তিনি কি তাদের চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেননি?

আবরাহার মূল উদ্দেশ্য ছিল কাবা ধ্বংস করা, কিন্তু আল্লাহ তার ষড়যন্ত্র সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ করে দেন। এটি প্রমাণ করে যে, আল্লাহ সব ধরনের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে সক্ষম।

৩. وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْرًا أَبَابِيلَ

উচ্চারণ: ওয়া আরসালা ‘আলাইহিম তাইরান আবাবীল।
অর্থ: এবং তিনি তাদের বিরুদ্ধে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি পাঠিয়েছিলেন।

আল্লাহ বিশেষভাবে "আবাবীল" নামে এক ধরনের পাখি পাঠিয়েছিলেন, যারা আবরাহার সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ করেছিল। সাধারণত পাখি কোনো বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম নয়, কিন্তু আল্লাহর নির্দেশে এই পাখিরা এক অলৌকিক শক্তি ধারণ করেছিল।

৪. تَرْمِيهِم بِحِجَارَةٍۢ مِّن سِجِّيلٍۢ

উচ্চারণ: তারমীহিম বিহিজারাতিম মিন সিজ্জীল।
অর্থ: তারা (পাখিরা) তাদের ওপর নিক্ষেপ করছিল পোড়ামাটির কংকর।

সিজ্জীল বলতে পোড়ামাটির বিশেষ ধরনের শক্ত পাথর বোঝায়, যা অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক ছিল। এই ছোট ছোট পাথর আল্লাহর নির্দেশে এত শক্তিশালী ছিল যে, সেনাবাহিনীর দেহ ফুটো হয়ে গিয়েছিল

৫. فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍۢ مَّأْكُولٍۢ

উচ্চারণ: ফাজা'আলাহুম কা'আসফিম মা'কুল।  
অর্থ: ফলে তিনি তাদের করে দিলেন খাওয়া খড়কুটোর মতো।

"আসফিম মা'কূল" বলতে বোঝানো হয়েছে গবাদি পশুর খাওয়া ও পরিত্যক্ত খড়-কুটা, যা কোনো মূল্যহীন বস্তু। অর্থাৎ, একসময় যারা বিশাল বাহিনী নিয়ে এসেছিল, তারা এক মুহূর্তে কিছুই না হয়ে গেল

তাফসীরের মূল শিক্ষা

১. আল্লাহই সর্বশক্তিমান – সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনীও তাঁর ইচ্ছার সামনে অসহায়।

২. ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যর্থ হয় – অন্যায়ভাবে যারা আল্লাহর ঘর বা বান্দাদের ক্ষতি করতে চায়, তারা ধ্বংস হবে।

3. আল্লাহর সাহায্য অবশ্যম্ভাবী – যখন সত্যের ওপর নির্ভর করা হয়, তখন আল্লাহ তাঁর বান্দাদের রক্ষা করেন।

৪. সত্যের বিজয় ও অন্যায়ের পরাজয় – দুনিয়ার সব শক্তি ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা চিরস্থায়ী।

মন্তব্য। সূরা ফীল বাংলা উচ্চারণ, শানে নুযূল, ফজিলত,  শিক্ষা ও তাফসিল

সুপ্রিয় পাঠক, আজকে রাতে গেলে একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছেগেছি। আশা করি আজকের এই আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ধর্যধরে পড়ার মাধ্যমে ইতিমধ্যে জানতে পেরেছেনসূরা ফীল বাংলা উচ্চারণ, শানে নুযূল, ফজিলত,  শিক্ষা ও তাফসিল। 

সূরা ফীল আমাদের শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহই প্রকৃত রক্ষক ও ন্যায়বিচারক। কোনো স্বৈরশাসক বা দুনিয়ার শক্তিশালী বাহিনী চিরকাল টিকে থাকতে পারে না। যারা আল্লাহর আদেশ অমান্য করে, তারা পরিণামে ধ্বংস হবেই।

এই কারণে আমাদের সবসময় আল্লাহর ওপর ভরসা করতে হবে এবং অন্যায় ও জুলুম থেকে বেঁচে থাকতে হবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url