মেসওয়াকের বৈজ্ঞানিক উপকারিতা ও মেসওয়াক করার নিয়ম
মেসওয়াকের বৈজ্ঞানিক উপকারিতা ও মেসওয়াক করার নিয়ম আলোচনা করা হয়েছে আজকের এই পোস্টটিতে। আপনি যদি এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান তাহলে এই পোস্টটির সাথেই থাকুন।
চলুন, কথা না বাড়িয়ে এবং আপনারা মূল্যবান সময় নষ্ট না করে আজকের গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় মেসওয়াকের বৈজ্ঞানিক উপকারিতা ও মেসওয়াক করার নিয়ম জেনে নিন। তহলে, পোস্টটির মূল আলোচনা যাওয়া যাক।
মেসওয়াক করা কী?
মেসওয়াক করা মানে হলো দাঁত পরিষ্কার করার জন্য বিশেষ ধরনের কাঠি ব্যবহার করা। এটি মূলত এক ধরনের প্রাকৃতিক টুথব্রাশ, যা বিভিন্ন গাছের ডাল থেকে তৈরি করা হয়, বিশেষ করে আরাক (Salvadora persica) গাছ থেকে।
মেসওয়াক করা শুধু দাঁতের যত্ন নয়, এটি ইসলামী সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত আমল, যা স্বাস্থ্যকর ও পরিবেশ বান্ধবও বটে।
মেসওয়াকের বৈজ্ঞানিক উপকারিতা
মেসওয়াক (Miswak) বা সিওয়াক (Siwak) হলো একটি প্রাকৃতিক দাঁত পরিষ্কারের কাঠি, যা সাধারণত আরাক গাছ (Salvadora persica) থেকে তৈরি করা হয়।
এটি হাজার বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং আধুনিক বিজ্ঞানও এর অনেক উপকারিতার স্বীকৃতি দিয়েছে। মেসওয়াকের বৈজ্ঞানিক উপকারিতা নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১. অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ: মেসওয়াকে থাকা প্রাকৃতিক অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান (যেমন সালভাডোরিন, ট্যানিন, ফ্ল্যাভোনয়েডস) দাঁতের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোধ করতে সাহায্য করে, যা দাঁতের ক্ষয় এবং মাড়ির রোগ প্রতিরোধ করে।
২. দাঁত পরিষ্কার রাখে ও প্লাক দূর করে: মেসওয়াকের তন্তুগুলো ব্রাশের মতো কাজ করে, যা দাঁতের প্লাক (plaque) দূর করতে সাহায্য করে এবং দাঁতকে স্বাভাবিকভাবে সাদা রাখে।
৩. মুখের দুর্গন্ধ দূর করে: মেসওয়াকের প্রাকৃতিক সুগন্ধি উপাদান মুখের দুর্গন্ধ কমাতে সাহায্য করে এবং মুখকে দীর্ঘ সময় সতেজ রাখে।
৪. মাড়ির স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়: মেসওয়াকে থাকা ট্যানিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস মাড়ির প্রদাহ কমায়, রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে এবং মাড়ির সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
৫. ফ্লুরাইডের প্রাকৃতিক উৎস: মেসওয়াকে স্বল্প মাত্রায় ফ্লুরাইড থাকে, যা দাঁতের ক্ষয় প্রতিরোধে সহায়তা করে এবং দাঁতের এনামেলকে শক্তিশালী করে।
৬. অতিরিক্ত কেমিক্যাল মুক্ত ও পরিবেশবান্ধব: টুথপেস্ট ও ব্রাশে থাকা কেমিক্যাল যেমন ট্রাইক্লোসান ও সালফেট ক্ষতিকর হতে পারে, কিন্তু মেসওয়াক সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং পরিবেশবান্ধব।
৭. দাঁতের সংবেদনশীলতা কমায়: মেসওয়াক নিয়মিত ব্যবহারে দাঁতের সংবেদনশীলতা কমে, কারণ এটি প্রাকৃতিকভাবে এনামেল রক্ষা করে এবং দাঁতের শিকড়কে শক্তিশালী করে।
৮. লালা উৎপাদন বৃদ্ধি করে: মেসওয়াক চেবানোর ফলে মুখে লালার প্রবাহ বাড়ে, যা প্রাকৃতিকভাবে ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে এবং মুখের পিএইচ ব্যালেন্স ঠিক রাখে।
মেসওয়াক শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বৈজ্ঞানিকভাবেও এটি দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষায় অত্যন্ত কার্যকর। নিয়মিত মেসওয়াক ব্যবহারে মুখের স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং এটি রাসায়নিক-মুক্ত একটি প্রাকৃতিক বিকল্প হিসেবে কাজ করে।
মেসওয়াক করার নিয়ম
মেসওয়াক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করলে দাঁতের স্বাস্থ্য আরও ভালো থাকে এবং এর সর্বোচ্চ উপকারিতা পাওয়া যায়।
১. মেসওয়াকের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ: সাধারণত ৮-১০ ইঞ্চি লম্বা ও ছোট আঙুলের সমান মোটা একটি মেসওয়াক ব্যবহার করা উত্তম। এটি ধরে রাখা ও ব্যবহারের জন্য সুবিধাজনক হয়।
২. মেসওয়াকের মুখ খোলা ও তন্তু তৈরি করা: মেসওয়াকের একপাশ থেকে প্রায় ১ ইঞ্চি ছাল তুলে ফেলুন। এরপর নরম তন্তু তৈরি করতে দাঁত দিয়ে চিবিয়ে বা পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। যখন তন্তু শক্ত হয়ে যাবে, তখন নতুন করে ছাল তুলে নরম করুন।
৩. মেসওয়াক ধরা ও ব্যবহারের নিয়ম: ডান হাতে মেসওয়াক ধরা সুন্নত। তিনটি আঙুলে (তর্জনী, মধ্যমা ও বৃদ্ধাঙ্গুলি) ধরে ব্যবহার করুন। মেসওয়াক করার সময় দাঁতে আড়াআড়ি বা লম্বালম্বি ঘষা না দিয়ে, উপর থেকে নিচের দিকে (উল্লম্বভাবে) ঘষা ভালো।
দাঁতের সামনের, পেছনের ও চিবানোর অংশে ভালোভাবে মেসওয়াক করুন। মাড়ি ও জিহ্বার ওপর হালকাভাবে ঘষতে পারেন, এটি মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে সাহায্য করবে।
৪. কখন মেসওয়াক করা উত্তম: প্রতিবার ওযুর সময় (নামাজের পূর্বে)। ঘুম থেকে উঠে। খাওয়ার আগে ও পরে।মসজিদে প্রবেশের আগে। যখন মুখে দুর্গন্ধ অনুভব করবেন তখন।
৫. কতবার মেসওয়াক করা উচিত: দিনে কমপক্ষে ৩-৫ বার ব্যবহার করা ভালো। বিশেষত ঘুমানোর আগে ও খাবার খাওয়ার পর করা বেশি উপকারী।
৬. মেসওয়াক ব্যবহারের পর কী করতে হবে: ব্যবহারের পর মেসওয়াক ভালোভাবে ধুয়ে শুকিয়ে রাখুন। কিছুদিন পরপর মেসওয়াকের তন্তু কাটতে হবে ও নতুন অংশ ব্যবহার করতে হবে। নষ্ট বা দুর্গন্ধযুক্ত মেসওয়াক ব্যবহার করা ঠিক নয়।
মেসওয়াক করার এই নিয়মগুলো অনুসরণ করলে দাঁত ও মাড়ির সুস্থতা বজায় থাকবে, মুখের দুর্গন্ধ দূর হবে এবং এটি সুন্নত পালনেও সাহায্য করবে।
মেসওয়াক করার দোয়া
মেসওয়াক করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো হাদিসপ্রমাণিত দোয়া নেই, তবে উলামায়ে কেরামরা ওযু করার সময় নিযতসহ নিম্নলিখিত দোয়াটি পড়ার পরামর্শ দেন:
মেসওয়াক করার দোয়া:
اللَّهُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ وَأَعِنِّي عَلَىٰهُ
উচ্চারণ:
“اللَّهُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ وَأَعِنِّي عَلَيْهِ”
অর্থ:
“হে আল্লাহ! এতে আমার জন্য বরকত দান করুন এবং এটি ব্যবহারে আমাকে সাহায্য করুন।”
এছাড়া, কেউ চাইলে ওযুর দোয়া পড়তে পারেন এবং মেসওয়াক করার সময় বিসমিল্লাহ বলা সুন্নত।
কোন গাছের মেসওয়াক ভালো
মেসওয়াক সাধারণত বিভিন্ন গাছের ডাল থেকে তৈরি করা যায়, তবে ইসলামিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু গাছের মেসওয়াক বিশেষভাবে ভালো বলে গণ্য করা হয়।
১. আরাক গাছ (Salvadora Persica): সবচেয়ে উত্তম, এটি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় মেসওয়াকের গাছ। এতে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিফাঙ্গাল উপাদান রয়েছে, যা দাঁতের জন্য উপকারী। দাঁতের ক্ষয়, প্লাক ও মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে সাহায্য করে।
২. নিম গাছ (Azadirachta Indica): প্রাকৃতিক জীবাণুনাশক ও দাঁতের সংক্রমণ রোধ করে। মাড়ি মজবুত রাখে এবং মুখের দুর্গন্ধ দূর করে।
৩. পিলু গাছ (Salvadora Oleiodes): এটি আরাক গাছের মতোই কার্যকর। দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো রাখে ও মাড়ির রক্তক্ষরণ কমায়।
৪. জয়তুন গাছ (Olea Europaea): কোরআনে জয়তুনের প্রশংসা করা হয়েছে। এতে থাকা প্রাকৃতিক তেল দাঁতের এনামেল রক্ষা করে।
৫. বাবলা গাছ (Acacia Arabica): মাড়ি শক্তিশালী করে ও দাঁতের সংবেদনশীলতা কমায়। মুখের ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকে রোধ করে।
কোন গাছের মেসওয়াক পরিহার করা উচিত: বিষাক্ত বা তেতো স্বাদের গাছ (যেমন: ধুতুরা, অ্যাকাশিয়া, বা অজানা গাছ)।খুব শক্ত গাছের ডাল, যা দাঁতের এনামেল ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
সবচেয়ে ভালো মেসওয়াক হলো আরাক গাছের, তবে নিম, পিলু, জয়তুন এবং বাবলা গাছও ভালো বিকল্প হতে পারে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url