সূরা ফালাক বাংলা উচ্চারণসহ অরবি অর্থ, শিক্ষা, ফজিলত ও শানে নযুল
সূরা ফালাক বাংলা উচ্চারণসহ অরবি অর্থ, শিক্ষা, ফজিলত ও শানে নযুল আলোচনা করা হয়েছে আজকের এই পোস্টটিতে। সূরা ফালাক সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই আর্টিকেলটির সাথেই থাকুন।
তাহলে চলুন, কথা না বাড়িয়ে এবং আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট না করে আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেলটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার মাধ্যমে জেনে নিন সূরা ফালাক বাংলা উচ্চারণসহ অরবি অর্থ, শিক্ষা, ফজিলত ও শানে নযুল।
সূরা ফালাক বাংলা উচ্চারণ সহ অর্থ
সূরা আল-ফালাক (সূরা নং ১১৩) কুরআনের একটি ছোট কিন্তু গভীর তাৎপর্যপূর্ণ সূরা। নিচে এর বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ দেওয়া হলো:
সূরা আল-ফালাক:
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
অর্থ: পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে।
قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ الْفَلَقِۙ(۱)
কুল আউযু বিরব্বিল ফালাক।
অর্থ: বলুন, আমি আশ্রয় চাই ভোরের প্রভুর কাছে,
مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَۙ(۲)
মিন শাররি মা খালাক।
অর্থ: তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট থেকে,
وَمِنْ شَرِّ غَاسِقٍ اِذَا وَقَبَۙ(۳)
ওয়া মিন শাররি গাসিকিন ইজা ওয়াকাব।
অর্থ: অন্ধকার রাতে যখন তা নেমে আসে, তার অনিষ্ট থেকে,
وَمِنْ شَرِّ النَّفّٰثٰتِ فِي الْعُقَدِۙ(۴)
ওয়া মিন শাররিন নাফফাসাতি ফিল উক্বাদ।
অর্থ: গাঁটে ফুঁ দেয় এমন জাদুকারিণীদের অনিষ্ট থেকে,
(۵) وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَ
ওয়া মিন শাররি হাসিদিন ইজা হাসাদ।
অর্থ: এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে।
সূরা ফালাক এর শিক্ষা
সূরা আল-ফালাক আমাদের জীবনের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও বার্তা বহন করে। নিচে এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা তুলে ধরা হলো:
সূরা ফালাক থেকে নেওয়া শিক্ষা:
আল্লাহই একমাত্র আশ্রয়স্থল: মানুষ যত বিপদ বা অনিষ্টে পড়ুক না কেন, প্রকৃত নিরাপত্তা ও আশ্রয় কেবল আল্লাহর কাছেই পাওয়া যায়।
তিনি “ফালাক” অর্থাৎ ভোরের আলো ফোটানোর মালিক—অন্ধকার শেষে আলো দেওয়ার ক্ষমতা তাঁরই।
অনিষ্ট থেকে বাঁচার দোয়া: এই সূরার মাধ্যমে শেখানো হয় যে, আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইবো সব ধরনের ক্ষতির (যেমন: মানুষের বা জ্বিনের অনিষ্ট, জাদু, হিংসা) হাত থেকে।
রাত্রিকালীন অশুভতা: রাতে অনেক অজানা বিপদ, ভয় ও ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। তাই রাতের অন্ধকারের সময় আল্লাহর আশ্রয় নেওয়ার গুরুত্ব রয়েছে।
জাদু ও কুপ্রভাব থেকে সুরক্ষা: এ সূরায় জাদুকর বা নফ্ফাসাত (গাঁটে ফুঁ দেওয়া জাদুকারিণী) এর অনিষ্ট থেকে রক্ষার দোয়া আছে। এতে বোঝা যায়, ইসলাম জাদুর অস্তিত্ব স্বীকার করে এবং তার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার উপায় শেখায়।
হিংসা মারাত্মক: হিংসা একটি ধ্বংসাত্মক মানসিকতা, যা অন্যের ক্ষতি করতে পারে। আল্লাহ তাআলা হিংসুকের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় নিতে বলেছেন, কারণ হিংসা কেবল মন নয়, কাজেও ভয়ানক রূপ নিতে পারে।
সংক্ষেপে শিক্ষা: সূরা ফালাক আমাদের শেখায়, জীবনের সকল ধরনের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বিপদ থেকে বাঁচতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা জরুরি। এটি একটি আত্মরক্ষা ও আত্মশুদ্ধির দোয়া।
সূরা ফালাকের ব্যাখ্যা
সূরা ফালাকের ব্যাখ্যা (তাফসীর): সূরা ফালাক (সূরা ১১৩) পবিত্র কুরআনের একটি মাক্কী সূরা। এতে ৫টি আয়াত রয়েছে।
এটি মূলত মানুষের ওপর আসা বাহ্যিক ও অদৃশ্য অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার মাধ্যমে রক্ষা পাওয়ার জন্য শেখানো হয়েছে।
আয়াত-অনুযায়ী ব্যাখ্যা:
১. قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ
“বলুন: আমি আশ্রয় চাই ফালাক (ভোর)-এর প্রতিপালকের।”ফালাক অর্থ ভোরের আলো, যা অন্ধকার ছিন্ন করে আসে।
আল্লাহ যিনি আলো সৃষ্টি করেন, তিনি অন্ধকার বা অনিষ্ট দূর করার ক্ষমতাও রাখেন।
এখানে ‘ফালাক’-এর প্রভু বলতে বোঝানো হয়েছে সেই সত্তা যিনি সবকিছুর সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণ করেন, বিশেষ করে আলো ও মুক্তি এনে দেন।
২. مِن شَرِّ مَا خَلَقَ
“তিনি যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট থেকে।” সব সৃষ্টি ভাল হলেও, কিছু কিছু সৃষ্টির আচরণ বা অবস্থা অনিষ্টের কারণ হতে পারে (যেমন: আগুন, হিংস্র জন্তু, মানুষ বা জ্বিন)।
এই আয়াতে শিখানো হচ্ছে: সব সৃষ্টির খারাপ দিক বা বিপদ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে হবে।
৩. وَمِن شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ
“অন্ধকার রাতে যখন তা নেমে আসে, তার অনিষ্ট থেকে।”গাসিক মানে গভীর রাত বা ঘোর অন্ধকার।
রাতের আঁধারে অনেক বিপদ, অপরাধ বা অশুভ কাজ ঘটে।এটি বোঝায় রাতের অজানা ভয় বা ক্ষতির হাত থেকে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া।
৪. وَمِن شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ
“গাঁটে ফুঁ দেয় এমন জাদুকারিণীদের অনিষ্ট থেকে।”এটি সরাসরি জাদু ও জাদুকরীদের উল্লেখ করে। প্রাচীনকালে জাদুকরীরা গাঁটে গাঁটে ফুঁ দিয়ে মানুষের ক্ষতি করত।
জাদু একটি বাস্তব ক্ষতিকর বিষয় — এর হাত থেকে আত্মরক্ষা প্রয়োজন।
৫. وَمِن شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ
“এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে।” হাসিদ অর্থ হিংসুক। হিংসা এমন এক ব্যাধি যা মানুষের শান্তি নষ্ট করে, এমনকি কারও ক্ষতির জন্য সক্রিয় হয়।
এখানে বলা হয়েছে, হিংসা যদি কাজের রূপ নেয় (যেমন, বদদোয়া, ষড়যন্ত্র), তখন তা খুব ভয়ংকর হতে পারে।
সার-সংক্ষেপ:
সূরা ফালাক আমাদের শেখায়, বাহ্যিক অনিষ্ট (রাত, জাদু, হিংসা) থেকে বাঁচতে কেবলমাত্র আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া উচিত।
এই সূরা মূলত একটি আত্মরক্ষার দোয়া — যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ভয়, হিংসা, এবং অদৃশ্য অনিষ্ট থেকে রক্ষায় সহায়ক।
সূরা ফালাকের ফজিলত
সূরা আল-ফালাকের ফজিলত (গুণাগুণ ও মাহাত্ম্য): সূরা ফালাক এবং সূরা নাস—এই দুই সূরাকে একত্রে “মু’আউয়িযাতাইন” বলা হয়, অর্থাৎ "আশ্রয় প্রার্থনার সূরাগুলো"।
এই সূরাগুলোর অনেক ফজিলত হাদীসে এসেছে, বিশেষ করে আত্মরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য।
১. সব ধরনের অনিষ্ট থেকে রক্ষার দোয়া: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: "তুমি সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়ো, এ দু’টি সূরার মতো আর কোনো কিছুতেই (অনিষ্ট থেকে বাঁচার) জন্য আশ্রয় চাওয়া হয়নি।" (তিরমিযী: ৩৫৭৫)
এই দুটি সূরা পড়লে জাদু, হিংসা, জ্বিনের কুপ্রভাব, রাতের ভয় এবং দুশ্চিন্তা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
২. সকালে ও সন্ধ্যায় নিয়মিত পাঠের ফজিলত: আবদুল্লাহ ইবনে খুবাইব (রা.) থেকে বর্ণিত: "প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক এবং সূরা নাস তিনবার করে পাঠ করলে তা তোমার জন্য সমস্ত কিছুর থেকে যথেষ্ট হবে।
"(আবু দাউদ: ৫০৮২)। নিয়মিত পাঠকারীর ওপর আল্লাহর হেফাজত থাকে।
৩. ঘুমের আগে সূরা ফালাক পাঠের আমল: রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘুমাতে যাওয়ার আগে সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়ে নিজ হাতে ফুঁ দিয়ে পুরো শরীরে হাত বুলিয়ে নিতেন। (বুখারী: ৫০১৭। এটি এক ধরনের রূহানী সুরক্ষা।
৪. জাদু ও বদনজর থেকে বাঁচার জন্য: সূরা ফালাকে জাদু, হিংসা এবং সব ধরনের অদৃশ্য ক্ষতির বিরুদ্ধে ঢালস্বরূপ ব্যবহার করা হয়।
সূরা ফালাকের শানে নুযূল
সূরা আল-ফালাকের শানে নুযুল (অবতরণের পটভূমি): সূরা ফালাকের অবতরণের পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রয়েছে, যা হাদীস ও তাফসীর গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায়।
এটি মূলত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর যাদুর (জাদুর) প্রভাব এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর রক্ষা পাওয়ার ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত।
ঘটনার সারসংক্ষেপ (শানে নুযুল):
জাদুর ঘটনা: ইহুদি গোত্রের একজন, যার নাম ছিল লুবায়িদ ইবন আল-আ'সম, সে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর যাদু করে।
সে এক ধরনের জাদু করে, যার ফলে নবীজি (সা.) কিছু সময়ের জন্য অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কিছু বিভ্রান্তিকর অনুভব করেন।
এ যাদু করা হয় তাঁর ব্যবহৃত চিরুনি ও কিছু চুল ব্যবহার করে এবং একটি খেজুরের ছোবড়ার মধ্যে বেঁধে কুয়ায় ফেলে রাখা হয়।
আল্লাহর সাহায্য: পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে সেই যাদুর বিষয়টি জানিয়ে দেন এবং কোথায় লুকানো আছে, তাও বলে দেন। তখন এই সূরা ফালাক ও সূরা নাস অবতীর্ণ হয়।
নবীজি (সা.) তখন উক্ত যাদুর প্রতিটি গাঁট খুলছিলেন, আর প্রতি গাঁট খুলে একটি করে আয়াত পড়ছিলেন — এভাবে পুরো যাদুর প্রভাব দূর হয়ে যায়।
তথ্যসূত্র: সহীহ বুখারী (হাদীস: ৫৭৬৩), সহীহ মুসলিম, তাফসীর ইবন কাসীর, সূরা ফালাক।
সূরা ফালাকের শানে নুযুল আমাদের শিক্ষা দেয়— জাদু বাস্তব, তবে আল্লাহর অনুমতি ছাড়া তা কার্যকর হয় না। আল্লাহর নাজিলকৃত দোয়ার মাধ্যমে (যেমন সূরা ফালাক ও নাস), সব অপশক্তি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
এটি কেবল রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য নয়, আমাদের সবার জন্যই এক প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র—আল্লাহর ভাষায় সুরক্ষা।
মন্তব্য। সূরা ফালাক বাংলা উচ্চারণসহ অরবি অর্থ, শিক্ষা, ফজিলত ও শানে নযুল
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url