পাম তেলের উপকারিতা ও অপকারিতা এবং পাম তেলের পুষ্টগুন জানুন

পাম তেলের উপকারিতা ও অপকারিতা এবং পাম তেলের পুষ্টগুন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে আজকের এই পোস্টটিতে। আপনি যদি এই বিষয়ে জানতে আগ্রহী থাকেন তাহলে এই পোস্টটি শুধুমাত্র আপনার জন্য উপকারী হতে চলেছে।
তাহলে চলুন কথা না বাড়িয়ে আজকের এই পোস্টটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার মাধ্যমে জেনে নিন পাম তেলের উপকারিতা ও অপকারিতা এবং পাম তেলের পুষ্টগুন সম্পর্কে। আসুন মূল আলোচনায় যাওয়া যাক।

পাম তেলের উপকারিতা:

পাম তেল (Palm Oil) একটি বহুল ব্যবহৃত ভোজ্য তেল যা তালের ফল (oil palm fruit) থেকে উৎপাদিত হয়। এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা নিচে দেওয়া হলো:

উচ্চ শক্তি প্রদানকারী: পাম তেলে প্রচুর ক্যালরি থাকে, যা দেহে দ্রুত শক্তি জোগাতে সহায়তা করে।

ভিটামিনে সমৃদ্ধ: এতে ভিটামিন A ও E (বিশেষ করে tocotrienols নামে একটি ফর্ম) থাকে, যা চোখের জন্য ভালো এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে।

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণাবলী: পাম তেলের প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান শরীরকে ফ্রি র‍্যাডিক্যালের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারে

দীর্ঘদিন সংরক্ষণযোগ্য: পাম তেল সহজে অক্সিডাইজ হয় না, ফলে এটি দীর্ঘদিন ভালো থাকে এবং রান্নার জন্য উপযোগী থাকে।

চুল ও ত্বকের যত্নে ব্যবহৃত: কিছু প্রসাধনী এবং বডি লোশনে পাম তেল ব্যবহৃত হয় কারণ এটি ত্বক ও চুলকে মসৃণ করে এবং আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে।

রান্নার জন্য উপযুক্ত: উচ্চ তাপমাত্রায় রান্নার সময় পাম তেল খুব স্থিতিশীল থাকে, ফলে এটি ভাজার জন্য ভালো।

যদিও পাম তেলের কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকিও আছে (যেমন অতিরিক্ত গ্রহণ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে), তবে পরিমিত ও সঠিক ব্যবহারে এটি উপকারী হতে পারে।

পাম তেলের অপকারিতা

পাম তেল যেমন কিছু উপকারিতা রাখে, তেমনি অতিরিক্ত বা অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে কিছু অপকারিতা বা স্বাস্থ্যঝুঁকিও তৈরি করতে পারে। নিচে পাম তেলের প্রধান কিছু অপকারিতা তুলে ধরা হলো:

পাম তেলের অপকারিতা:

স্যাচুরেটেড ফ্যাটের আধিক্য: পাম তেলে প্রচুর পরিমাণে স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে, যা বেশি খাওয়া হলে কোলেস্টেরল বাড়াতে পারে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

রিফাইন্ড তেলের ক্ষতি: অনেক সময় বাজারে পাওয়া পাম তেল অত্যধিক পরিশোধিত (refined) থাকে, যার ফলে এর প্রাকৃতিক পুষ্টিগুণ নষ্ট হয় এবং ক্ষতিকর পদার্থ তৈরি হতে পারে।

অতিরিক্ত গরম করলে ক্ষতিকর উপাদান তৈরি হয়: পাম তেল বারবার গরম বা পুনরায় ব্যবহারে অ্যক্রোলিন বা অন্যান্য বিষাক্ত যৌগ তৈরি হতে পারে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

ওজন বৃদ্ধি: উচ্চ ক্যালরি ও ফ্যাট থাকার কারণে অতিরিক্ত পাম তেল গ্রহণ করলে ওজন বাড়তে পারে এবং এর ফলে ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ে।

হজমে সমস্যা: অনেকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বা ভারী তেলে রান্না করা খাবার হজমে সমস্যা, গ্যাস্ট্রিক বা এসিডিটির সৃষ্টি করতে পারে।

পরিবেশগত ক্ষতি (প্রত্যক্ষ নয়, তবে গুরুত্বপূর্ণ): পাম তেল উৎপাদনের জন্য অরণ্য উজাড় হয়, যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর।

পাম তেল একেবারে পরিহার না করলেও, পরিমিত পরিমাণে, ভালো মানের (কম রিফাইন্ড) পাম তেল ব্যবহার করা উচিত এবং বারবার গরম করা তেল এড়ানো ভালো।

পাম তেলের পুষ্টিগুণ 

নিচে পাম তেলের পুষ্টিগুণ গুলো সহজ ভাষায় ধারাবাহিকভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:

১. ক্যালরি (শক্তি): পাম তেল খুব বেশি ক্যালরি সরবরাহ করে। প্রতি ১০০ গ্রামে প্রায় ৮৮৪ কিলোক্যালরি থাকে। তাই এটি শক্তি চাহিদা পূরণে সহায়ক।

২. ফ্যাটের ধরন: পাম তেলের সবটুকুই ফ্যাট, যার মধ্যে তিন ধরনের ফ্যাট থাকে:
  • স্যাচুরেটেড ফ্যাট: প্রায় অর্ধেক অংশ, যা বেশি হলে কোলেস্টেরল বাড়ায়।
  • মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট: প্রায় ৩৯%, যা হৃদপিন্ডের জন্য কিছুটা উপকারী।
  • পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট: তুলনামূলক কম পরিমাণে, যা শরীরের জন্য দরকারি ফ্যাটি অ্যাসিড সরবরাহ করে।
৩. ভিটামিন A (বিটা-ক্যারোটিন): অপরিশোধিত বা "রেড পাম অয়েল"-এ বিটা-ক্যারোটিন থাকে, যা শরীরে ভিটামিন A-তে রূপান্তরিত হয়। এটি চোখ, ত্বক ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।

৪. ভিটামিন E (Tocotrienols): পাম তেলে ভিটামিন E-এর বিশেষ একটি ফর্ম থাকে, যাকে বলা হয় tocotrienols। এটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা কোষকে ফ্রি র‍্যাডিক্যালের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।

৫. কোলেস্টেরল: পাম তেল নিজে কোলেস্টেরলমুক্ত হলেও, এতে থাকা স্যাচুরেটেড ফ্যাট শরীরের LDL (খারাপ কোলেস্টেরল) বাড়াতে পারে, যদি অতিরিক্ত খাওয়া হয়।

পাম তেল শক্তি ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিনের উৎস হলেও, এর স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ বেশি হওয়ায় পরিমিত ও সঠিকভাবে ব্যবহার করা স্বাস্থ্যকর।

পাম তেল কিভাবে তৈরি হয়

পাম তেল তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া বেশ কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়। নিচে সংক্ষেপে ধাপগুলো তুলে ধরা হলো:

১. ফল সংগ্রহ (Harvesting): পাম গাছের থোকা থোকা ফল (oil palm fruit) সংগ্রহ করা হয়। এই ফলগুলো রক্তিম-কমলা রঙের হয় এবং প্রতিটি থোকায় শত শত ছোট ফল থাকে।

২. ফল সিদ্ধকরণ (Sterilization): সংগ্রহের পর ফলগুলো বড় স্টিমার বা বয়লারে সিদ্ধ করা হয়। এতে ফল নরম হয় এবং এর মাধ্যমে জীবাণুমুক্তও হয়।

৩. ফল চাপানো (Threshing): সিদ্ধ ফল থেকে ফলগুলো আলাদা করা হয় থ্রেশিং মেশিনের মাধ্যমে।

৪. তেল নিষ্কাশন (Oil Extraction): এই ধাপে ফলগুলো প্রেস মেশিনে চেপে তেল বের করা হয়। ফল থেকে বের হয় ক্রুড পাম অয়েল (CPO)—এটি হলো অপরিশোধিত পাম তেল।

৫. তেল বিশোধন (Refining): ক্রুড পাম অয়েল বিভিন্ন ধাপে পরিশোধন করা হয় (ডিগামিং, ব্লিচিং, ডিওডোরাইজিং), যার ফলে এটি পরিষ্কার, গন্ধহীন ও ভোজ্য হয়।

৬. সংরক্ষণ ও প্যাকেজিং: বিশোধিত পাম তেল বড় ট্যাংকে রাখা হয়, তারপর বোতলে বা ড্রামে প্যাক করা হয় বিক্রির জন্য।

এই প্রক্রিয়া মূলত ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে সম্পন্ন হয় এবং উন্নত মেশিনারি ব্যবহার করা হয়। চাইলে আমি ছবি বা ডায়াগ্রামের সাহায্যে পুরো প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করতে পারি—আপনি চাইলে জানাতে পারেন!

পাম ফলের ছবি

পাম গাছের ছবিসহ পাম গাছের ফলের থোকা, পাম গাছের ফল ও পাম ফলের গঠনের ছবি নিম্নে দেওয়া হলো। আপনাদের মধ্যে যারা পাম গাছ ও পাম ফল দেখেননি তাদের জন্য এই প্রতিবেদনটি।


পাম ফলের থোকা: এই ফলগুলো গাছে থোকা আকারে জন্মে। প্রতিটি থোকায় শত শত ছোট ফল থাকে, যা সাধারণ লালচে  বা কমলা রঙের হয়।

পাকা পাম ফল: পাকা পাম ফলের রং উজ্জ্বল লাল সেবা কমলা হয়। 

পাম ফলের গঠন: প্রতিটি ফলের বাইরের আবরণ মসৃণ ও উজ্জ্বল, ভেতরে একটি শক্ত বিজ থাকে। 

পাম ফলের গাছ: পাম গাছের কান্ড পাতা বড় বড় হয় এগুলো কাছাকাছি অংশে থোকা  আকারে ধরে।

পাম অয়েল ও সয়াবিন তেলের পার্থক্য 

পাম অয়েল ও সয়াবিন তেলের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে যা নিচে ধারাবাহিকভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:

1. উৎস
  • পাম অয়েল: পাম গাছের ফল থেকে পাওয়া যায়।
  • সয়াবিন তেল: সয়াবিন বীজ থেকে নিষ্কাশিত হয়।

2. রঙ ও গন্ধ
  • পাম অয়েল: প্রাকৃতিকভাবে লালচে বা হালকা হলুদ রঙের হয় (রিফাইন্ড হলে ফ্যাকাশে), সামান্য গন্ধযুক্ত।
  • সয়াবিন তেল: হালকা হলুদ বা প্রায় সাদা রঙের, তুলনামূলকভাবে কম গন্ধযুক্ত।
3. ফ্যাটের ধরন
  • পাম অয়েল: উচ্চ স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে, যা শরীরের জন্য বেশি হলে ক্ষতিকর হতে পারে।
  • সয়াবিন তেল: বেশি পরিমাণে পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে, যা হ্রদযন্ত্রের জন্য অপেক্ষাকৃত উপকারী।
4. রান্নার উপযোগিতা
  • পাম অয়েল: উচ্চ তাপমাত্রায় স্থিতিশীল, ভাজার জন্য ভালো।
  • সয়াবিন তেল: হালকা রান্না বা সাধারণ ভাজা-পোড়ার জন্য ভালো, অতিরিক্ত গরমে গুণ নষ্ট হতে পারে।
5. স্বাস্থ্যদিক
  • পাম অয়েল: অতিরিক্ত গ্রহণে কোলেস্টেরল ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
  • সয়াবিন তেল: ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা স্বাস্থ্যকর হলেও অতিরিক্ত গ্রহণে প্রদাহ বাড়তে পারে।
6. সংরক্ষণ ক্ষমতা
  • পাম অয়েল: সহজে নষ্ট হয় না, দীর্ঘদিন সংরক্ষণযোগ্য।
  • সয়াবিন তেল: দ্রুত অক্সিডাইজ হয়, তুলনামূলকভাবে কম দিন ভালো থাকে।

পাম তেলের দাম

২০২৫ সালের ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের বাজারে পাম তেলের সর্বশেষ দাম নিম্নরূপ:

বাংলাদেশে পাম তেলের দাম (এপ্রিল ২০২৫): খোলা পাম তেল: প্রতি লিটার ১৬৯ টাকা (আগে ছিল ১৫৭ টাকা)

এই দামটি বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক নির্ধারিত এবং ১৩ এপ্রিল ২০২৫ থেকে কার্যকর হয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে পাম তেলের দাম: ২০২৫ সালের শুরু থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে পাম তেলের দাম প্রায় ৫.৫৪% হ্রাস পেয়ে বর্তমানে প্রতি মেট্রিক টন ৪,৫২৯.৩২ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (MYR) এ পৌঁছেছে।

মূল্য পরিবর্তনের কারণ: আন্তর্জাতিক বাজারে দাম হ্রাস: বিশ্ববাজারে পাম তেলের দাম কমেছে, যা দেশের বাজারেও প্রভাব ফেলেছে।
সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য: উৎপাদন বৃদ্ধি এবং চাহিদা হ্রাসের ফলে দাম কমেছে।

ভোক্তাদের জন্য পরামর্শ: দাম পরিবর্তনের খোঁজ রাখুন: বাজারে তেলের দাম পরিবর্তনশীল, তাই নিয়মিত খোঁজ রাখা উচিত।

প্রয়োজন অনুযায়ী ক্রয় করুন: দামের ওঠানামা বিবেচনায় রেখে প্রয়োজন অনুযায়ী তেল ক্রয় করুন।

মন্তব্য। পাম তেলের উপকারিতা ও অপকারিতা এবং পাম তেলের পুষ্টগুন জানুন।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url