সূরা কাহফ বাংলা উচ্চারণসহ অরবি অর্থ, শিক্ষা, ফজিলত ও শানে নযুল
সূরা কাহফ বাংলা উচ্চারণসহ অরবি অর্থ, শিক্ষা, ফজিলত ও শানে নযুল আলোচনা করা হয়েছে আজকের এই পোস্টটিতে। সূরা কাহফ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই আর্টিকেলটির সাথেই থাকুন।
তাহলে চলুন, কথা না বাড়িয়ে এবং আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট না করে আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেলটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার মাধ্যমে জেনে নিন সূরা কাহফ বাংলা উচ্চারণসহ অরবি অর্থ, শিক্ষা, ফজিলত ও শানে নযুল।
সূরা কাহফ বাংলা উচ্চারণ সহ অরবি অর্থ
সূরা কাহফ (সূরা আল-কাহফ) কুরআনের ১৮ নম্বর সূরা। নিচে সূরার কিছু আয়াত বাংলা উচ্চারণ ও আরবি অর্থসহ দেওয়া হলো। পুরো সূরাটি বেশ বড়, তাই আমি প্রথম কয়েকটি আয়াত দিচ্ছি। চাইলে আমি পুরো সূরাটিও দিতে পারি ধাপে ধাপে।
সূরা আল-কাহফ
আয়াত ১
আরবি: ٱلْحَمْدُ لِلَّهِ ٱلَّذِىٓ أَنزَلَ عَلَىٰ عَبْدِهِ ٱلْكِتَـٰبَ وَلَمْ يَجْعَل لَّهُۥ عِوَجًاۜ
বাংলা উচ্চারণ: আলহামদু লিল্লাহিল্লাযী আনযালা ‘আলা ‘আব্দিহিল কিতাবা ওয়া লাম ইয়াজ‘আল লাহু ‘ইওয়াজা।
বাংলা অর্থ: সব প্রশংসা আল্লাহর, যিনি তাঁর বান্দার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন এবং এতে কোনো বক্রতা রাখেননি।
আয়াত ২
আরবি: قَيِّمًا لِّيُنذِرَ بَأْسًا شَدِيدًۭا مِّن لَّدُنْهُ وَيُبَشِّرَ ٱلْمُؤْمِنِينَ ٱلَّذِينَ يَعْمَلُونَ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا حَسَنًۭا
বাংলা উচ্চারণ: কাইয়্যিমান লিযুনযিরা বাআসান শাদীদাম মিল্লাদুন্নিহি ওয়া ইউবাসশিরাল মু’মিনীনাল্লাযীনা ইয়াঅ’মালূনাস্ সালিহাতি আন্না লাহুম আজরান হাসানা।
বাংলা অর্থ: যা সরল ও সঠিক, যাতে সে সতর্ক করতে পারে কঠিন শাস্তি সম্বন্ধে আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং সুসংবাদ দিতে পারে মু’মিনদেরকে, যারা সৎকর্ম করে—যে তাদের জন্য রয়েছে উত্তম প্রতিদান।
আয়াত ৩
আরবি: مَّـٰكِثِينَ فِيهِ أَبَدًۭا
বাংলা উচ্চারণ: মা-কি-সীনা ফীহি আবাদা।
বাংলা অর্থ: তারা তাতে চিরকাল থাকবে।
সূরা কাহফ এর শিক্ষা
সূরা কাহফ (আল-কাহফ) থেকে আমরা অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাই। এই সূরাটি বিশেষ করে ফিতনা (বিভ্রান্তি, পরীক্ষা) সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে এবং কীভাবে ঈমান ঠিক রাখা যায় তা শেখায়। নিচে সূরাটি থেকে নেওয়া কিছু মূল শিক্ষা তুলে ধরা হলো:
সূরা কাহফের মূল শিক্ষা:
ক) আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান ও তাওহিদে অটল থাকা: গুহাবাসী যুবকরা (আসহাবে কাহফ) আল্লাহর উপর ঈমান রেখে অন্যায় শাসকের মুখোমুখি হয়ে গুহায় আশ্রয় নেয়। এতে আল্লাহ তাদের রক্ষা করেন।
শিক্ষা: ঈমানের পথে অবিচল থাকলে আল্লাহ সাহায্য করেন।
খ) দুনিয়ার ধন-সম্পদ ফানির—আখিরাতই চিরস্থায়ী: ধনাঢ্য ও গরিব দুই ব্যক্তির কাহিনিতে দেখা যায়, ধনী ব্যক্তি অহংকার করায় আল্লাহ তার সব ধ্বংস করে দেন।
শিক্ষা: দুনিয়াবি সম্পদে গর্ব না করে তা আল্লাহর পথে ব্যবহার করতে হবে।
গ) জ্ঞান অর্জনের জন্য বিনয় জরুরি: হযরত মূসা (আ.) ও খিজির (আ.)-এর ঘটনাতে মূসা (আ.) দেখান কিভাবে একজন নবী হয়েও আরও জ্ঞান অর্জনের জন্য বিনয় প্রকাশ করেন।
শিক্ষা: সত্যিকারের জ্ঞানী সে, যে জ্ঞানের অন্বেষণে বিনয়ী থাকে।
ঘ) আখিরাতের ন্যায়বিচার: সূরার শেষভাগে বলা হয়, যারা দুনিয়ার জীবনে শুধু বাহ্যিক কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে, অথচ আল্লাহর নির্দেশ অনুসরণ করে না—তাদের কর্ম আখিরাতে কোনো মূল্য পাবে না।
শিক্ষা: কাজের উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি হতে হবে।
ঙ) দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়: হাদীস অনুযায়ী, সূরা কাহফের প্রথম ১০ আয়াত বা শেষ ১০ আয়াত মুখস্থ রাখলে দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
শিক্ষা: কুরআনের শিক্ষা ও হিফজ দুনিয়ার ও আখিরাতের নিরাপত্তা দেয়।
সূরা কাহাফের ব্যাখ্যা
সূরা কাহফ (সূরা নম্বর ১৮) কুরআনের একটি বিশেষ গুরুত্বসম্পন্ন সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ এবং মোট ১১০টি আয়াত রয়েছে।
এটি মূলত কিছু ঘটনা ও কাহিনী কেন্দ্রিক সূরা, যেগুলোর প্রতিটির মধ্য দিয়ে ঈমান, ধৈর্য, জ্ঞান, দুনিয়া ও আখিরাতের বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। নীচে সূরা কাহফের সারসংক্ষেপ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো:
সূরা কাহফের চারটি প্রধান কাহিনী ও ব্যাখ্যা:
১. আসহাবে কাহফ (গুহাবাসী যুবকরা)
আয়াত: 9–26
সংক্ষেপে কাহিনী: কিছু যুবক যারা নিজেদের জাতির শিরক ও অন্যায় থেকে রক্ষা পেতে আল্লাহর উপর ভরসা করে একটি গুহায় আশ্রয় নেয়। আল্লাহ তাদের ৩০৯ বছর নিদ্রায় রাখেন।
ব্যাখ্যা: এই কাহিনী শেখায় যে ঈমানের জন্য ত্যাগ স্বীকার করলে আল্লাহ তার বিশেষ সহায়তা দেন। সময়ের ফিতনা থেকে বাঁচার জন্য সমাজ থেকে পৃথক হওয়াও কখনো কখনো জরুরি হয়।
২. দুই বন্ধুর কাহিনী (ধনী ও গরিব)
আয়াত: 32–44
সংক্ষেপে কাহিনী: এক ধনী ব্যক্তি তার বাগান ও সম্পদ নিয়ে অহংকার করে, গরিব বন্ধুকে অবমূল্যায়ন করে। কিন্তু একদিন তার সব সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়।
ব্যাখ্যা: এখানে শেখানো হয় যে দুনিয়ার ধন-সম্পদ অস্থায়ী। অহংকার ও আল্লাহকে অস্বীকার করার পরিণতি ধ্বংস। কৃতজ্ঞতা ও বিনয়ী হওয়াই প্রকৃত ঈমানদারের গুণ।
৩. মূসা (আ.) ও খিযির (আ.) এর ঘটনা
আয়াত: 60–82
সংক্ষেপে কাহিনী: মূসা (আ.) মনে করেন তিনি সবচেয়ে জ্ঞানী। আল্লাহ তাকে শিক্ষা দেন যে জ্ঞান সীমাহীন এবং খিযির (আ.)-এর সঙ্গে সফরে পাঠান। সেখানে এমন কাজ হয় যেগুলোর তাৎক্ষণিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
ব্যাখ্যা: শেখায় যে সবকিছুর পেছনে আল্লাহর পরিকল্পনা থাকে। মানুষকে বিনয়ী থাকতে হয়, কারণ সব জ্ঞান আমাদের নেই।
৪. যুল-ক্বারনাইন (দুল-ক্বারনাইন) এর অভিযান
আয়াত: 83–98
সংক্ষেপে কাহিনী: যুল-ক্বারনাইন একজন ন্যায়পরায়ণ ও শক্তিশালী শাসক ছিলেন। তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেন, মানুষদের সাহায্য করেন এবং ইয়াজুজ-মাজুজের বিরুদ্ধে একটি প্রাচীর নির্মাণ করেন।
ব্যাখ্যা: এই কাহিনী থেকে বোঝা যায়, নেতৃত্বের ক্ষমতা মহান দায়িত্ব। ন্যায়বিচার ও জনগণের কল্যাণে শক্তিকে ব্যবহার করাই ঈমানদারের পরিচয়।
সূরা কাহফের এর ফজিলত
সূরা কাহফের ফজিলত (সূরা আল-কাহফ) কুরআনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূরাগুলোর একটি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ সূরার অনেক ফজিলতের কথা বলেছেন।
বিশেষ করে দাজ্জালের ফিতনা থেকে বাঁচা এবং জুমার দিনের গুরুত্ব নিয়ে। সূরা কাহফের ফজিলতসমূহ:
১. দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়
হাদীস: রাসূল (সা.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি সূরা কাহফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করবে, সে দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষা পাবে।" – (সহীহ মুসলিম: 809)
আরেক বর্ণনায় আছে: "যে ব্যক্তি সূরা কাহফের শেষ দশ আয়াত মুখস্থ করবে, সে দাজ্জাল থেকে নিরাপদ থাকবে।"– (মুসলিম, তিরমিজি)
ব্যাখ্যা: দাজ্জাল আসার সময় তার মিথ্যা ও বিভ্রান্তি থেকে ঈমান রক্ষা করার জন্য সূরা কাহফ একটি ঢালস্বরূপ কাজ করবে।
২. জুমার দিনে সূরা কাহফ তিলাওয়াতের ফজিলত
হাদীস: রাসূল (সা.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি জুমার দিন সূরা কাহফ তিলাওয়াত করবে, তার জন্য দুই জুমা পর্যন্ত নূর (আলো) প্রকাশিত থাকবে।" – (সুনান দারিমি, হাদীস: 3407)
অন্য হাদীসে: "জুমার দিন যে সূরা কাহফ তিলাওয়াত করবে, সে এক জুমা থেকে অন্য জুমা পর্যন্ত আলোকিত থাকবে, আর তার গুনাহ মাফ করা হবে।" – (আল-হাকিম)
৩. আখিরাতের আলো ও হেদায়াতের উৎস
সূরা কাহফে দুনিয়া ও আখিরাতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা হয়েছে—ফিতনা, ধৈর্য, পরীক্ষা, তাওহিদ, ও ন্যায়বিচার। এটি ঈমানকে দৃঢ় করে এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করে।
সূরা কাহাফ এর শানে নুযুল
সূরা কাহফের শানে নুযুল (অবতীর্ণ হওয়ার পটভূমি): সূরা আল-কাহফ মক্কী সূরা, অর্থাৎ এটি মক্কা মুয়াযযামায় অবতীর্ণ হয়।
এটি তখন নাজিল হয় যখন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দাওয়াত দিন দিন ছড়িয়ে পড়ছিল এবং কুরাইশরা এতে বিরক্ত ও চিন্তিত হচ্ছিল।
তারা রাসূল (সা.)-এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কিছু প্রশ্ন তৈরি করেছিল, যাতে তাকে বিপদে ফেলা যায় বা মিথ্যাবাদী প্রমাণ করা যায়।
শানে নুযুলের ঘটনা সংক্ষেপে:
১. কুরাইশদের চক্রান্ত ও ইহুদিদের সাথে পরামর্শ: কুরাইশরা মদিনার ইহুদিদের কাছে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, কারণ তারা জানত ইহুদিরা আসমানি কিতাব জানে। ইহুদিরা কুরাইশদের বলেছিল:
“তোমরা তাকে তিনটি প্রশ্ন করো, যদি সে সঠিকভাবে উত্তর দেয়, তবে সে সত্য নবী।
প্রশ্নগুলো হলো:
- গুহাবাসী যুবকদের (আসহাবে কাহফ) কাহিনী কী?
- দুল-ক্বারনাইন কে ছিলেন?
- রূহ (আত্মা) কী?”
২. রাসূল (সা.)-এর উত্তরের জন্য অপেক্ষা: রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন বলেছিলেন, “আমি কাল তোমাদেরকে উত্তর দেব,” কিন্তু “ইনশাআল্লাহ (আল্লাহ চাইলে)” বলেননি। ফলে ১৫ দিন পর্যন্ত ওহি আসেনি, এবং তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
তখন সূরা কাহফ অবতীর্ণ হয়, যাতে:
উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া হয়,
এবং রাসূল (সা.)-কে শিখানো হয়:
“وَلَا تَقُولَنَّ لِشَاىْءٍ إِنِّيْ فَاعِلٌ ذٰلِكَ غَدًا، إِلَّآ أَنْ يَشَآءَ اللّٰهُ”
(সূরা কাহফ, আয়াত ২৩-২৪)
"তুমি কোনো বিষয়ে এ কথা বলো না যে, ‘আমি এটা কাল করব’— আল্লাহ চাহেন, তা না বললে।"
মূল বার্তা:
সূরাটি শুধু প্রশ্নের উত্তর নয়, বরং নবি হওয়ার সত্যতা, ধৈর্য, আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরতা, এবং ঈমানের শক্ত ভিত প্রতিষ্ঠার দিকনির্দেশনা দেয়।
তুমি চাইলে এই সূরার প্রতিটি কাহিনির পিছনের শিক্ষাগুলোও আলাদা করে বিশ্লেষণ করে দিতে পারি। আগ্রহ থাকলে বলো কোনটা আগে চাও – গুহাবাসী যুবক, ধনী-গরিব বন্ধু, মূসা-খিযির, না দুল-ক্বারনাইন?
মন্তব্য। সূরা কাহফ বাংলা উচ্চারণসহ অরবি অর্থ, শিক্ষা, ফজিলত ও শানে নযুল
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url